উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকাগুলো ফসল উৎপাদনে যথেষ্ঠ অন্তরায় হলেও এবার পাটের বাম্পার ফলন হয়েছে। খরিফ-১ মৌসুমে এসব এলাকার অধিকাংশ কৃষক অনেকটা বেকার বসে থাকে। কেউ কেউ সামান্য চাষাবাদ করে। তবে লবণাধিক্যের কারণে উৎপাদন অনেকাংশে ব্যাহত হয়। ফলে তারা কাজে আগ্রহ হারায়। তবে এবারের পাটের ফলন চাষিদের বেশ অবাক করেছে। তারা খুশিতে এখন আত্মহারা। যেসময় লবণাক্ততার কারণে ফসলই হয় না সেখানে পাটের সর্বোচ্চ ফলন। এতো অকল্পনীয় বাস্তব। এসব কথা এখন ওখানকার কৃষকের মুখেমুখে।
দেশের মোট চাষ উপযোগি শতকরা ৩০ ভাগ জমি উপকূলীয় বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত। এর পরিমাণ প্রায় ২ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন হেক্টর। এসব জমির মধ্যে প্রায় ১ দশমিক ০৬ মিলিয়ন হেক্টর লবণাক্ত। দিন দিন এর মাত্রা বেড়েই চলছে। এ বিশাল পরিমাণ জমি খরিফ-১ মৌসুমে লবণাক্তার কারণে পতিত থাকে। উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে পটুয়াখালীতে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ১ লাখ ৫৫ হাজার ১ শ’ ৮০ হেক্টর, সাতক্ষীরায় ১ লাখ ৫৩ হাজার ১ শ’ ১০ হেক্টর, খুলনায় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৯ শ’ ৬০ হেক্টর, বাগেরহাটে ১ লাখ ৩১ হাজার ১ শ’ ২০ হেক্টর, বরগুনায় ৫২ হাজার ৫ শ’ ২০ হেক্টর, ভোলায় ৯৪ হাজার ৫ শ’ ৭৯ হেক্টর, কক্সবাজারে ৫৫ হাজার ৩ শ’ ৫০ হেক্টর, নোয়াখালীতে ৫২ হাজার ৫ শ’ ২০ হেক্টর, চট্টগ্রামে ৫১ হাজার ৪ শ’ ৮০ হেক্টর এবং পিরোজপুরে ৩৫ হাজার ৮ শ’ ৩০ হেক্টর জমি। এসব লবণাক্ত জমিগুলো খরিফ-১ মৌসুমে পাট চাষের আওতায় আনার জন্য ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিজেআরআই) ‘পাট ও পাট জাতীয় ফসলের কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও হস্তান্তর’ প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে উপকূলীয় ৬ উপজেলায় বিজেআরআই উদ্ভাবিত মধ্যম লবণাক্তসহিষ্ণু (৯ ডিএস./ মিটার) পাটের জাত এবং লবণাক্তসহিষ্ণু ৪টি লাইনের মাঠ পর্যায়ে গবেষণাকার্যক্রম চলমান আছে। উপজেলাগুলো হলো: পটুয়াখালীর কলাপাড়া, বরগুনার বেতাগী, পিরোজপুরের নাজিরপুর, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, খুলনার দাকোপ ও সাতক্ষীরার সদর ।
চলতি বছরে এসব প্রতি উপজেলায় ৫০ জন চাষির প্রত্যেককে ১০ শতাংশ জমিতে পরীক্ষামূলক পাটের প্রদর্শনী দেয়া হয়। সহায়তা হিসেবে তাদের বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় বীজ ও রাসায়নিক সার, সেইসাথে বীজ সংরক্ষণের ড্রাম, কোদাল, কাস্তে এবং নিড়ানি দেয়া হয়। প্রদর্শনীভূক্ত ৬ শ’ জন চাষিকে চাষ কৌশল, পচন পদ্ধতি, পাটবীজ উৎপাদন এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া মাঠদিবস এবং মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।
বিজেআরআই’র মহাপরিচালক ড. মো. মঞ্জুরুল আলম প্রকল্পের এসব কার্যক্রম সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেন। এরই অংশ হিসেবে ২৯ জুলাই পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙ্গা গ্রামে স্থাপিত আজিজুল ইসলাম এবং শহিদ হাসান তমালের প্রদর্শনী প্লট পরিদর্শন করেন। পাটের ফলন দেখে তিনি অবিভূত হন। এসময় কৃষকদের উদ্দ্যেশে তিনি বলেন, “লবণাক্ত জমিতে ফসল উৎপাদনের জন্য লবণসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করেছি। খরিফ-১ মৌসুমে জমি খালি না রেখে সেখানে আউশ ধান করুন, সেই সাথে পাটও করুন। আমরা আপনাদের পাশেই আছি।”
একই উপজেলার রঘুনাথপুরের আছলাম শিকদারের প্লটে আবাদকৃত পাটের ফলন আরো আকর্ষণীয়। তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, “আমার জমির অধিকাংশ পাট গাছের উচ্চতা ১২ থেকে ১৪ ফুট, ব্যাস ৩০ থেকে ৩২ মিলিমিটার। প্রতিটি পাটের ওজন প্রায় ৬ শ’ ৫০ গ্রাম।” কৃষক আরো বলেন, “ আউশ মৌসুমে এখানে কোনো ফসল হতো না। উপজেলা কৃষি অফিস এবং পাট গবেষণার কর্মকর্তাদের পরামর্শে এবার পাট চাষ করেছি, ফলনও পেয়েছি অনেক।”
এ প্রসঙ্গে জাত উদ্ভাবক এবং উপপ্রকল্প পরিচালক (গবেষণা) ড. মাহমুদ আল হোসেন জানান, “পাট গাছ সাধারণত ৭ থেকে ৮ ফুট লম্বা এবং ১৮ থেকে ২০ মিলিমিটার মোটা হয়। প্রদর্শনীতে দেয়া বিজেআরআই দেশী পাট-৮ জাতটি লবণাক্ত এলাকার জন্য খুবই উপযোগি এবং এর উৎপাদনও অনেক বেশি। সময়মতো বীজ বপন, সুষম সার ব্যবহার, সঠিক পরিচর্যা এবং রোগ-পোকা দমন করলে ফলন যে কাক্সিক্ষত হয় তা কৃষকরা প্রমাণ করেছে।” তিনি আরো বলেন, “দক্ষিণাঞ্চলের চর এলাকায় বপন উপযোগি জলমগ্নসহিষ্ণু জাতের জন্য আমরা চারটি লাইন উদ্ভাবন করেছি। এগুলো হলো: C-2749, C-12221, P-17, P-24. লাইন গুলোর মধ্যে যেটির ফলাফল ভালো হবে, সেটি চরাঞ্চলের মাঠ মুল্যায়নের মাধ্যমে কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হবে। এছাড়া শাক হিসেবে একটি জাত উদ্ভাবন হয়েছে, যার নাম দেশী পাটশাক-১। এর পাতা ক্যান্সার প্রতিরোধি। সাগরকন্যা কুয়াকাটার সমুদ্রতীরবর্তী উচ্চ লবণাক্ত জমিতে পরীক্ষামূলক তিনটি প্রদর্শনী দেয়া হয়েছে, যার লবণাক্তের মাত্রা প্রতি মিটারে ১৫.৮ ডিএস.। সেখানেও ফলন ভালো হয়েছে।”
মহাপরিচালকের সফরসঙ্গি হিসেবে ছিলেন মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. চন্দন কুমার সাহা, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রনজিৎ কুমার ঘোষ, বরিশালস্থ কৃষি তথ্য সার্ভিসের আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন প্রমুখ।
সবশেষে বলব, চাষির মেধা ও শ্রম, সেই সাথে বিজেআরআই এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সহযোগিতার বিনিময়ে পাটের এ আকাশচুম্বি ফলন। এ ধারা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আগামীতে দেশের লবণাক্ত অঞ্চলগুলো সোনালি আঁশে ভরে যাবে। কৃষক সম্পদশালী হবে। দেশ হবে সমৃদ্ধ।